গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের ১৮ টি সতর্কতা জানেন কি?
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা এবং প্রথম তিন মাসে গর্ভপাতের লক্ষণ বিষয়ে আজকে আমরা আপনাদের জানাবো। একজন গর্ভবতী মায়ের পুরো গর্ভকালীন সময় একটা নতুন সময়। এ সময় গর্ভবতী মায়ের ও অনাগত সন্তানের অনেক ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের ঝুঁকির কারনে গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ ঘটে থাকে।
বিশ্বে প্রায় ১৫-২০ শতাংশ গর্ভবতী নারীর প্রথম তিন মাসের সতর্কতা অনুসরণ না করার কারনে গর্ভপাত ঘটে থাকে। অথচ গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা অনুসরণ করে এই বিপদ এড়ানো সম্ভব। গর্ভবতী নারীর প্রথম তিন মাসে যে সকল সতর্কতা অনুসরণ করা উচিত তা নিচে জানানো হলো।
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা
১। পেটে ধাক্কা বা চাপ লাগে এমন কাজ না করা
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে অবশ্য পেটে ধাক্কা লাগে বা চাপ লাগে এমন কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। যখন একজন নারী নিশ্চিত হবেন যে তিনি গর্ভবতী, তখন থেকে তার চলা ফেরায় সতর্ক হওয়া উচিত। অতিরিক্ত জোরে হাটা, ভারী কাজ করা, পরে গিয়ে পেটে ধাক্কা খাওয়া ইত্যাদি বিষয় এড়িয়ে চলা উচিত।
২। পুষ্টিকর খাবার খাওয়া
প্রথম তিন মাস থেকে শুরু করে গর্ভাবস্থায় পুরো সময়, একজন গর্ভবতী মায়ের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। কারন এই সময় একটি দেহে দুইটি প্রানের বসবাস। প্রথম তিন মাস থেকে গর্ভস্থ শিশুর বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির প্রয়োজন। তাই গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত।এছাড়া, পুষ্টিকর খাবার গর্ভবতী মায়ের নরমাল ডেলিভারি হওয়ার উপায় হিসেবে কাজ করে।
৩। গর্ভকালীন নিষিদ্ধ খাবার পরিহার করা
একজন গর্ভবতী মায়ের প্রথম চার মাসের সতর্কতা হিসাবে কিছু নিষিদ্ধ খাবার পরিহার করা উচিত। যেমন কম রান্না করা খাবার, পাস্তুরিত নয় এমন দুধ, আনারস, পেপে, অতিরিক্ত চা ও কফি ইত্যাদ। প্রথম তিন মাসে একজন গর্ভবতী নারীর নিষিদ্ধ খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে এই খাবার গুলো থেকে দূরে থাকা জরুরী।
৪। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মাদক সেবন না করা
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসেবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধুমপান বা মদ্যপান থেকে দূরে থাকা উচিত। এছাড়া অতিরিক্ত এলোকোহোল যুক্ত কোল্ড ড্রিংকস পরিহার করা উচিত। কারন এগুলো গর্ভের শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ন। এছাড়া এর প্রভাবে গর্ভপাত ঘটতে পারে।
৫। ডাক্তারের পরামর্শে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেওয়া
একজন নারী গর্ভবতী নিশ্চিত হওয়ার পর, অবশ্যই একজন ডাক্তারের পরামর্শে প্রয়োজনীয় টেস্ট ও গর্ভবতী মায়ের ঔষধ সেবন করা জরুরী। কারন গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসে ফলিক এসিড সহ প্রয়োজনীয় কিছু ঔষধ খেতে হয়। এছাড়া ব্রুনটি ঠিকঠাক মতো রোপিত হয়েছে কিনা সেটা বোঝার জন্য আলট্রাসনোগ্রাফি করতে হয়। তাই গর্ভবতী নারীর প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে অবশ্যই একজন ডাক্তার দেখানো জরুরী।
৬। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ঔষধ না খাওয়া
আমরা অনেকেই বিভিন্ন সময় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ খাই। কিন্তু গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের ঔষধ খাওয়া উচিত না। কারন কিছু ঔষধের প্রভাব, প্রথম তিন মাসে গর্ভপাতের কারণ হতে পারে।
৭। টেনশন ও মানসিক চাপ কমানো
গর্ভবতী হওয়ার খবর পাওয়ার পর, গর্ভবতী মায়ের নানা ধরনের টেনশন বা দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এসময় অতিরিক্ত টেনশন করলে বাচ্চার ও গর্ভবতী মায়ের শরীরের উপর প্রভাব পরে। তাই গর্ভবতী মায়ের প্রথম ২ মাসের সতর্কতা হিসাবে অতিরিক্ত টেনশন নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
৮। গর্ভকালীন ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা
আজকাল অনেক নারীদের ডায়াবেটিস থাকে। এছাড়া যাদের ডায়াবেটিস নাই তাদেরও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের মাত্রা বেশি থাকলে তা প্রথম তিন মাসে গর্ভপাতের লক্ষণ হতে পারে বা গর্ভপাত ঘটাতে পারে। তাই গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে অবশ্যই নিয়মিত গর্ভকালীন ডায়াবেটিস চেক করা ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী।
৮। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
গর্ভবতী নিশ্চিত হওয়ার পর, অনেক নারীদের দুশ্চিন্তা সহ নানা কারনে ব্লাড প্রেসার বাড়তে পারে। আবার অনেকের ব্লাড প্রেসার কমে যেতে পারে। রক্তচাপ বেশি বা কম হওয়া গর্ভস্থ শিশু ও মায়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ন। তাই গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে অবশ্যই নিয়মিত ব্লাড প্রেসার চেক করে নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী। কারো হাই প্রেসার থাকলে দ্রুত হাই প্রেসার কমানোর উপায় ফলো করা উচিত।
৯। অতিরিক্ত বমি ও মাথা ব্যাথার চিকিৎসা করা
গর্ভবতী মায়ের বমি ও মাথা ব্যাথা হওয়া স্বাভাবিক। তবে কারো যদি অতিরিক্ত বমি হয়, তাহলে শরীরের পানি শূন্যতা তৈরি হতে পারে। যা শিশুর ও মায়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া কোন গর্ভবতী মায়ের যদি প্রচন্ড মাথা ব্যাথা ও চোখে ঝাপসা দেখা শুরু হয় তাহলে তার দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।
কারন এটি গর্ভবতী মায়ের পাঁচটি বিপদ চিহ্ন এর একটি। এছাড়া এটি প্রথম তিন মাসে গর্ভপাতের লক্ষণ। তাই গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে অতিরিক্ত বমি ও প্রচন্ড মাথা ব্যাথার বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
১০। কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাসের চিকিৎসা
একজন নারী গর্ভবতী হওয়ার পর কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাসের সমস্যা দেখা দিতে পার। কারন এই সময় শরীরের বিভিন্ন উপাদান গুলো গর্ভস্থ ব্রুনের বৃদ্ধির জন্য কাজ করে। তাই গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে একজন ডাক্তারের পরামর্শে কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাসের চিকিৎসা করা প্রয়োজন।
১১। পেটে ব্যাথা ও হঠাৎ রক্তস্রাবের চিকিৎসা করা
গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসে পেট ব্যাথা ও হঠাৎ রক্তস্রাব এর বিষয় লক্ষ্য রাখা জরুরী। কারন এই দুটি একলামশিয়ার প্রাথমিক লক্ষন বা প্রথম তিন মাসে গর্ভপাতের লক্ষণ। অতিরিক্ত তল পেটে ব্যাথা ও হঠাৎ রক্তস্রাব যেহেতু গর্ভপাতের লক্ষন। তাই এরকম হলে গর্ভবতী মাকে দ্রুত চিকিৎসের কাছে নিয়ে যাওয়া জরুরী।
১২। মর্নিং সিকনেস কন্ট্রোল করা
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসে মর্নিং সিকনেস হওয়া স্বাভাবিক। এই সময় প্রায় সকল গর্ভবতী মায়ের সকাল বেলা ক্লান্তি অনুভব করা, বমি হওয়া ও অস্থির লাগা কাজ করে। এটাকে গর্ভবতী মায়ের মর্নিং সিকনেস বলে। গর্ভবতী মায়ের প্রথম চার মাসের সতর্কতা হিসাবে মর্নিং সিকনেস মানিয়ে নেওয়ার চেস্টা করা উচিত। এটা নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা পরিহার করা উচিত।
১৩ ঠান্ডা লাগে এমন কাজ না করা
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে ঠান্ডা লাগে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। বিশেষ করে ঠান্ডা খাবার খাওয়া থাকা বিরত থাকা উচিত। কারণ গর্ভবস্থায় প্রথম তিন মাসে গর্ভবতী মায়ের ঠান্ডা লাগা মা ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর।
১৪। দূরের জার্নি না করা
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে দূরের জার্নি করা থেকে বিরত থাকা উচিত। বিশেষ করে পেটে ঝাঁকুনি লাগে এমন জার্নি করা উচিত না। এর ফলে গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসে পেট ব্যাথা হতে পারে বা গর্ভপাত ঘটতে পারে।
১৫। প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন নেওয়া
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে মা ও সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন নেয়া উচিত। এজন্য একজন ডাক্তারের পরামর্শে যেসব ভ্যাকসিন প্রয়োজন, কিন্তু নেয়া হয়নি সেগুলো সময়মত নেয়া উচিত। কারন ভ্যাকসিন গর্ভবতী মা ও সন্তানের কিছু সিরিয়াস রোগ প্রতিরোধ করে।
১৬। হাটা চলা করা
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে সারাদিন শুয়ে-বসে না থেকে হালকা হাঁটাচলা করা উচিত। কারণ এসময় হালকা হাঁটাচলা করা শরীরের জন্য ভালো। তবে এটা একজন ডাক্তারের পরামর্শে হওয়া উচিত। কারন একেক জনের শরীরে একেক ধরনের জটিলতা থাকতে পারে।
১৭। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা হিসাবে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া ও ঘুম প্রয়োজন। কারন এই সময় গর্ভে থাকা ব্রুন টির বৃদ্ধি ঘটাতে শরীর কাজ করতে থাকে। তাই এসময় গর্ভবতী মায়ের পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রামের প্রয়োজন।
১৮। গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সহবাসে সতর্কতা
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সহবাসে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। অনেক দম্পতি এই সময় সহবাস করতে গিয়ে বিপদ ঘটান। গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সহবাসে পেটে ধাক্কা বা চাপ লাগে এমন ভাবে সহবাস করা উচিত নয়। এতে গর্ভপাত ঘটতে পারে। যদি নিশ্চিত করা যায় যে, সহবাসে গর্ভবতী মায়ের পেটে ধাক্কা বা ঝাকুনি লাগবে না, তাহলে সহবাস করা যাবে।
আমাদের শেষ কথা
আজকে আমরা আপনাদের জানালাম, গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা। যে গুলো অবহেলা করলে একজন গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসে গর্ভপাতের লক্ষন দেখা দিতে পারে বা গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে।
এছাড়া গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা অনুসরণ না করলে মা ও সন্তানের স্বাস্থ্যগত অসুবিধা দেখা দিতে পারে। তাই একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক সন্তান জন্ম দানের জন্য একজন গর্ভবতী মায়ের প্রথম থেকেই ঝুকির বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন থাকা উচিত। এবং গর্ভবতী মায়ের বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত।